সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ১৩৭ দশমিক ৫০ একর আয়তনের শাহ আরেফিন টিলার নিচে রয়েছে বড় বড় পাথরখণ্ড। এসব পাথর উত্তোলন করতে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে সরকারি খাস খতিয়ানের বিশাল এই টিলা। লালচে, বাদামি ও আঠালো মাটির এই টিলার পুরোটা খুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য গর্ত। বিশাল গহীন একেকটা গর্ত। মনে হয় অসংখ্য পুকুর খুঁড়ে রেখেছে কেউ।
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার জাফলংয়ের চিত্র আরও ভয়াবহ। জাফলং সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। তবে অপরিকিল্পিত ও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে এটি হারিয়ে ফেলেছে সৌন্দর্য। পাথর উত্তোলনের ধুলা, বিকট আওয়াজ ও ধ্বংসলীলার কারণে জাফলং এখন পর্যকদের দুঃস্বপ্ন।
ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে ২০১২ সালে জাফলংয়ের পিয়াইন নদীসহ ১৫ কিলোমিটার এলাকাকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়।
২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত এ সংক্রান্ত গেজেটে বলা হয়, ‘অপরিকল্পিতভাবে যেখানে-সেখানে পাথর উত্তোলন ও নানাবিধ কার্যকলাপের ফলে সিলেটের জাফলং-ডাউকি নদীর প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংকটাপন্ন, যা ভবিষ্যতে আরও সংকটাপন্ন হবে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। ইসিএভুক্ত এলাকায় যান্ত্রিক বা ম্যানুয়াল কিংবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে পাথরসহ অন্য যেকোনো খনিজ সম্পদ উত্তোলন নিষিদ্ধ।’
কেবল জাফলং আর শাহ আরেফিন টিলা নয়, এমন চিত্র সিলেটের প্রায় সবগুলো পাথর কোয়ারি এলাকার। পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছনাকান্দি ও লোভছড়া–এই পাঁচ কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে উচ্চ আদালত।
এমন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পাথর উত্তোলনের দাবি জানিয়ে আসছেন পাথর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকেরা। বছরখানেক ধরে এই দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন তারা। তবে এতে সুফল না পাওয়ায় এবার কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের দাবিতে মাঠে নেমেছেন পরিবহন ব্যবসায়ীরা।
সরকারকে নিজেদের দাবি মানাতে বাধ্য করতে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে পরিবহন মালিক সমিতি। সিলেটে তিন দিনের পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে তারা।
আগামী ২২, ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর সিলেট বিভাগে সব ধরনের যানবাহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে সিলেট বিভাগীয় ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান মালিক ঐক্য পরিষদ। এতে অন্য পরিবহন সংগঠনও একাত্মতা প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা।
পরিবেশকর্মীরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলনের ফলে সিলেটের কোয়ারিগুলোতে পাথরের স্থর অনেক নিচে নেমে গেছে, যা খালি হাতে তোলা সম্ভব নয়। এগুলো তুলতে এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করেন ব্যবসায়ীরা। বোমা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হয় বলে স্থানীয়ভাবে এগুলো ‘বোমা মেশিন’ নামে পরিচিত। এই যন্ত্রগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। উচ্চ আদালতও এগুলো নিষিদ্ধ করেছে।
তাদের দাবি, এখন পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হলে কোয়ারি মালিকেরা আশকারা পাবে। অনুমতি পেলে তারা বোমা মেশিন দিয়ে পরিবেশ ধ্বংস করে দেবে।
তবে পরিবহন মালিকেরা বলছেন, পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় সিলেটের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। পাথর শ্রমিকদের পাশাপাশি পারিবহন মালিক ও শ্রমিকেরাও সংকটে পড়েছেন। এ কারণে পাথর উত্তোলনের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগীয় ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান মালিক ঐক্য পরিষদ ও সিলেট জেলা ট্রাক মালিক গ্রুপের সভাপতি গোলাম হাদী ছয়ফুল বলেন, সিলেটে কোনো শিল্প কারখানা নেই। এখানকার ট্রাক কেবল পাথর পরিবহনেই ব্যবহৃত হয়। পাথর উত্তোলন বন্ধ হওয়ায় ট্রাক মালিক ও শ্রমিকেরা বিপাকে পড়েছেন।
তিনি বলেন, সিলেটের ট্রাক মালিকদের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। ট্রাক ভাড়া দিয়ে আয় করেই তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। এখন পাথর পরিবহন বন্ধ হওয়ায় মালিকেরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না।
হাদী আরও বলেন, পরিবহন খাতের লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় জাফলং ও ভোলাগঞ্জ সড়কে বাস ও অটোরিকশার যাত্রীও কমে গেছে।
অনুমতি পেলে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতেই পাথর উত্তোলন করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পাথর ব্যবসায়ীদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা কথা দিয়েছেন সরকার অনুমতি দিলে ম্যানুয়েল পদ্ধতিতেই তারা পাথর তুলবেন। আর কোনো যন্ত্রের ব্যবহার করবেন না। পরিবেশও ধ্বংস করবেন না। আমরাও বিষয়টি তদারকি করব।’
সিলেট জেলা ট্রাক-কাভার্ডভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবু সরকার বলেন, ‘কোয়ারি বন্ধ থাকলেও এক শ্রেণির লোক এখনও পাথর উত্তোলন করছে। কয়েক দিন আগেও আমি গিয়েছিলাম কোম্পানীগঞ্জের ধলাই নদীতে। সেখানে গিয়ে দেখেছি, মেশিন ব্যবহার করে পাথর উত্তোলন হচ্ছে। প্রতিদিন কোম্পানীগঞ্জ থানা লাখ লাখ টাকা নিচ্ছে।’
পরিবহন মালিকদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল জলিল বলেন, ‘পাথর খনিজ সম্পদ। আমাদের দাদারা খেয়েছেন, বাবারা খেয়েছেন, আমরা খাচ্ছি, আমাদের সন্তানরাও খাবেন। এভাবেই চলবে। এটি প্রকৃতির দান। কোনো দিনও এটি শেষ হবে না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘যখন নিষেধাজ্ঞা ছিল না তখনও সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে সামান্য পরিমাণ পাথর উত্তোলন হতো। বেশিরভাগই ভারত থেকে আমদানি করা হতো। আমদানি যেহেতু অব্যাহত রয়েছে, তাই পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
‘কোয়ারি ব্যবসায়ীরাই পরিবহন মালিক সংগঠনের নেতাদের মাঠে নামিমেছে। এই গোষ্ঠীর ইন্ধনেই কাজ করছেন তারা। অনুমতি পেলে পাথরখেকো গোষ্ঠী অযান্ত্রিকবাবে পাথর তুলবে না। তারা বোমা মেশিন দিয়েই পাথর তোলা শুরু করবে। কোনো অবস্থায়ই আর পাথর উত্তোলনের অনুমতি দেয়া যাবে না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, পরিবহণ মালিকদের অধিকাংশই পাথর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় তারা শ্রমিকদের ব্যবহার করছেন। তারা শ্রমিকদের ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তাদের স্বার্থ হাসিল করতে চাইছেন। তা না হলে পাথর বন্ধ থাকলেই যে পরিবহন শ্রমিকরা না খেয়ে মরবেন, তা নয়।
ফারুক মাহমুদ বলেন, ‘তারা এখন যে আন্দোলন করছেন এটা হাইকোর্ট অবমাননা করা হচ্ছে। তারা চাইলে হাইকোর্টে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু তা না করে জনসাধারণকে জিম্মি করার চেষ্টা করছেন। এটা অন্যায় এবং অপরাধ।’
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোর পাথর এরই মধ্যে ফুরিয়ে এসেছে। এখন চাহিদার ৭০ শতাংশ পাথরই আমদানি করা হয়। কিছু অংশ সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে উত্তোলন করা হতো। তবে এই পাথর উত্তোলন করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে অনেক গুণ বেশি।
কেবল পরিবেশ ধ্বংস নয়, অপরিকল্পিতভাবে পাথর উত্তোলনের ফলে সিলেটের কোয়ারিগুলোতে শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোয় ৭৬ জন পাথর শ্রমিক নিহত ও ২১ জন আহত হন।
সিলেটবিবিসি/রাকিব/ডেস্ক/ডিসেম্বর২১,২০২০